অধ্যক্ষের বাণী
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম,
আমরা নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দেখানো পথে স্বপ্ন দেখতে ভালবাসি। আমরা একটি সুন্দর,শান্তিময় ইসলামী সমাজ গড়তে পছন্দ করি। আমরা একটি নিরাপদ পরিবেশ, দেশ ও পৃথিবী চাই। আমরা একটি উন্নত ধার্মিক, সুন্নাতের অনুসারী ও নৈতিক মূল্যবোধভিত্তিক দেশপ্রেমিক জাতি গড়তে চাই। সমাজকে পাপ পঙ্কিলতা, জুলুম ও কলঙ্কমুক্ত দেখতে চাই। কিন্তু একটি ঘুণেধরা জাহেলী সমাজ যা আপাদমস্তক ডুবে আছে অপসংস্কৃতির বেড়াজালে, যেখানে মানবতা নেই, মূল্যবোধ নেই, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নেই স্রষ্টার সাথে সৃষ্টি ও প্রকৃতির সাথে মানুষের কোন যথার্থ নৈতিক বন্ধন, যে পৃথিবীতে প্রতিটি সূর্যোদয় হচ্ছে নির্যাতিত মানবতার রক্তে স্নাত হয়ে। তবে আমি কোন হতাশার কথা বলছি না, বরং আমাদের বোধশক্তিটুকু জাগ্রত করার মধ্য দিয়েই একটি সুন্দর জাতি, সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র, পৃথিবী, সর্বোপরি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়া সম্ভব। প্রয়োজন ত্যাগের মন-মানসিকতাসম্পন্ন একঝাঁক তরুণ, উদ্যমী ও সাহসী সন্তান। যারা শিক্ষা বাণিজ্য ও ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে সমাজকে একটি ধর্ম ও তাক্বওয়াভিত্তিক জনগোষ্ঠী উপহার দেবে।
সে লক্ষ্যে একদল দ্বীনদার, পরহেজগার, খাঁটি দেশপ্রেমিক যোগ্যতা সম্পন্ন আলেমেদ্বীন গড়ে তোলার অশায় একটা যুগোপযোগী মান সম্মত ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা ছিল এ অঞ্চলের গণমানুষের বহুদিনের লালিত স্বপ্ন। সে বাসনা হৃদয় ধারণ করে এলাকার প্রভাবশালী জমিদার হাওলাদার পরিবার বিশেষ করে মরহুম আল-হাজ্জ রচিম উদ্দীন হাওলাদার ও আল-হাজ্জ মোবারক আলী হাওলাদার সহ দানবীর ব্যক্তিদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও সহযোগীতায় ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের এক শুভলগ্নে প্রতিষ্ঠিত হয় অত্র প্রতিষ্ঠানটি। অতঃপর ১৯৪৭খ্রিঃ এতে আধ্যাত্মিক প্রাণ সঞ্চার করে এর তত্বাবধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন বর্তমান সম্মানিত সভাপতির মরহুম পিতা সুদূর মদীনা মুনাওয়ারা থেকে আগত মহানবী হযতর মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুযোগ্য উত্তরসূরী আওলাদে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল-হাজ্জ হযরত মাওলানা ছাইয়্যেদ মুহাম্মদ তাহের আহমদ জাবিরী আল-মাদানী (রাহ্ঃ)। তখন থেকে প্রতিষ্ঠানের নামের সাথে যুক্ত হয় “তাহেরিয়া ,”বর্তমান এর নাম “হায়দরগঞ্জ তাহেরিয়া আর.এম.কামিল মাদরাসা।” আমি অধম ০১/০৬/২০০৯খ্রিঃ মাদরাসার দায়িত্ব গ্রহণ করি। লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে সকলের সহযোগীতা ও দোয়া কামনা করছি।
মোহাম্মদ আবদুল আজিজ মজুসদার,
অধ্যক্ষ,
হায়দরগঞ্জ তাহেরিয়া আর.এম.কামিল মাদরাসা।
মাদ্রাসা শিক্ষার গুরুত্ব ও ইতিহাস-ঐতিহ্য
مدرسة শব্দটি درس শব্দ থেকে উদ্গত । অর্থ পড়া শোনা করা। আরবী ভাষার ব্যাকরণ নাহু অনুসারে مدرسة শব্দটি যরফে মাকান। সে মতে তার আভিধানিক অর্থ দাঁড়ায় পড়া শোনার স্থান,পাঠশালা বা বিদ্যালয়। অতএব, যে স্থানে ইলমে দ্বীন কুরআন-সুন্নাহ,তাফসীর,ফিকহ,প্রভৃতি শিক্ষা দেয়া হয়, তাকে مدرسة বলা হয়।
মাদ্রাসা শিক্ষার গুরুত্বঃ-
শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। যে জাতি যত শিক্ষিত, সে জাতি ততই উন্নত ও সভ্য। তবে হতে হবে সুশিক্ষিত। শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষার আলোই দেশ ও জাতির সফলতার চাবি কাঠি ও পথনির্দেশক। শিক্ষা মানুষকে প্রদান করে সাহায্য ও মর্যাদা। শিক্ষা দীক্ষা মানুষকে উন্নত থেকে উন্নতর জাতিতে পরিণত করে। মহান আল্লাহ শিক্ষা দীক্ষা জ্ঞানার্জনের প্রতি পবিত্র কুরআনে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন এবং বিশ্ব মানবতাকে উৎসাহীত করে বলেছেন। قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُون (হে রাসুল স.) আপনি বলুন যারা জানে এবং যারা জানেনা তারা কি সমান হতে পারে? (সুরা যুমার ৯) বস্তুতঃ মহান আল্লাহ এখানে মূর্খদের উপর জ্ঞানীদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে। যা সর্বজন স্বীকৃত। মূলতঃ মহান আল্লাহ উপরোক্ত আয়াতে মানব জাতির শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন।
পড়াশুনাইতো একমাত্র সবকিছু জানাশুনার মাধ্যম । তবে নিশ্চয় দ্বীনি শিক্ষা এবং মাদরাসা শিক্ষাই হলো অগ্রাধিকার। সকল মুসলমানদের জন্য সর্বপ্রথম দ্বীনি ইলেম কুরআন হাদীস শিক্ষা করা অতীব দরকার । রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন طلب العلم فريضة علي كل مسلم “প্রত্যেক মুসলমানের উপর ইলমে দ্বীন শিক্ষা করা ফরয।” উপরোক্ত হাদীস শরীফে ঐ শিক্ষাকেই বুঝানো হয়েছে। যা দ্বারা মানুষ তার সষ্ট্রার অস্তিত্ব ও একত্ববাদের সন্ধান পায়। সন্ধান পাওয়া যায় তাঁর রাসুলের রিসালাত ও সকল আদেশ নিষেধ এবং আদর্শের। আর এসব জ্ঞানের উৎস হলো মূলতঃ কুরআন ও হাদীস । সঙ্গত কারণেই দ্বীনি শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষার জ্ঞানার্জন করা অগ্রাধিকার। আল্লাহ বলেনالرَّحْمَنُ عَلَّمَ الْقُرْآنَ خَلَقَ الْإِنْسَان পরম করুনাময় আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন; সৃষ্টি করেছেন মানুষ। (সুরা আর রহমান ১-৩) বস্তুতঃ উল্লেখিত আয়াতের মধ্যে কুরআনিক শিক্ষাকে অগ্রে এবং মানব সৃষ্টিকে পশ্চাতে নিয়ে এসে আল্লাহ তায়ালা কুরআনিক শিক্ষা দীক্ষার চর্চা এবং গবেষনার অগ্রাধিকারকে স্পষ্ট করে দিয়েছেন। স্পষ্ট করে দিয়েছেন মানব সৃষ্টির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য । রাসুল (স.) বলেন تعلموا الفرائض والقران وعلموا الناس فاني مقبوض ইলমে মিরাস ও কুরআনকে শিখ এবং তা মানুষকে শিক্ষা দাও । কেননা আমাকে উঠিয়ে নেওয়া হবে ( জামে তিরমিজি) উপরোক্ত হাদীসের উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। হাদীস মূলত কুরআনেরই ব্যাখ্যা বিশ্লেষন। অতএব কুরআর ও হাদীসের শিক্ষার প্রতি সর্বপ্রথম মনোযোগী ও তৎপর হতে হবে। অতপরঃ কুরআন সুন্নাহ তথা দ্বীনি শিক্ষার সহায়ক ও সম্পূরকের লক্ষ্যে পার্থিব দুনিয়ার যে কোন ভাষা ও বিদ্যা শিক্ষা করাকে শরীয়ত অনুমোদন করে। উৎসাহিত করে সাহিত্য চর্চা ও সংস্কৃতি অনুশীলন করতে ।
ইতিহাস ও ঐতিহ্যঃ
ইতিহাসবিদগনের একটি অংশ অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেন যে, ঐতিহাসিক হেরা পর্বতের গুহায় ইক্রা প্রত্যাদেশের মাধ্যমে মহানবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (স.) কুরআনিক জ্ঞানের যে সুমহান ধারা লাভ করেছিলেন সে শিক্ষা চর্চা অব্যাহত রাখার নিমিত্তে আকরাম ইবনে আবুল আকরাম এর সাফা পাহাড়ের নিকটস্থ গৃহে এ ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্র তথা মাদরাসা শিক্ষার সূত্রপাত হয়েছিল।এই দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাদরাসার মহাপরিচালক ও শিক্ষক ছিলেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) স্বয়ং নিজেই। আর ছাত্র ছিলেন খুলাফায়ে রাশেদীন সহ অপরাপর সাহাবায়ে কিরাম রদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম আজমাঈন।
দাওয়াতের মিশন এগিয়ে চলছে। প্রিয় নবী (স.) থেমে নেই। থেমে নেই প্রিয় সাহাবী । যখন মহান আল্লাহর ইচ্ছা হলো ইসলামের প্রচার প্রসারের তখন মদীনা থেকে আগত আউস গোত্রের কিছু লোককে হজ্জের মওসুমে হুজুর (স.) ইসলামের দাওয়াত দিলেন। পরে গোত্রদ্বয়ের চিঠির মর্মানুযায়ী রাসুল্ল্লুাহ (স.) মুসয়াব ইবনে উমাইর (রা.) কে মদীনাবাসী নওমুসলিমগনের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করে পাঠান। ইহাই মদীনায় সর্বপ্রথম মাদরাসা শিক্ষা। হিজরতের পর মসজিদে নববীই ইসলামি শিক্ষার ঐতিহাসিক কেন্দ্ররূপে গড়ে উঠে। আর সে থেকেই মসজিদ কেন্দ্রিক চলে আসছে আদর্শ শিক্ষার এ ধারা মাদরাসা। মহানবী (স.) মসজিদে নববীর চত্বরে মাদরাসায়ে সুফ্ফা নামে একটি স্বতন্ত্র মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে ছিলেন। ইসলামী সভ্যতা সংস্কৃতি, চিন্তা-চেতনা তথা কুরানিক শিক্ষাকে সম্প্রসারনের নিমিত্তে নবী কারীম (স.) বিভিন্ন এলাকায় মুয়াল্লিম বা শিক্ষক প্রেরণ করতে থাকেন। ফলে মদীনা মুনাওয়ারার বিভিন্ন মহল্লায় মসজিদ ভিত্তিক এ ধরনের আরো অনেক মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে স্বল্প দিনের ভেতরেই এ শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক খ্যাতি লাভ করে। ক্রমান্বয়ে এ শিক্ষা মদীনার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (স.) এর জীবদ্দশাতেই আরব ভূখন্ডের দূর-দূরান্ত পর্যন্ত মসজিদ ভিত্তিক বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাদরাসা গড়ে উঠে। খোলাফায়ে রাশিদীনের সময় সাহাবায়ে কেরাম দ্বীনি শিক্ষা প্রচার প্রসারের লক্ষ্যে কুরআন হাদীস নিয়ে পৃথিবীর দিগি¦দিক ছড়িয়ে পড়েন। ফলে শিক্ষার পরিধি আরো সম্প্রসারিত হয়।এ সময় শিক্ষার মূল বিষয় বস্তু ছিল কুরআন সুন্নাহ,ফারায়িজ ও অন্যান্য আরো কিছু নিয়ম ভিত্তিক শিক্ষা। উমাইয়া খলিফা উমর বিন আব্দুল আজিজ (রহ.) এর শাসনকালের পূর্বকাল পর্যন্ত সময়কে ঐতিহাসিকগণ ইসলামী জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষা বিস্তারের প্রথম যুগ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর পর থেকে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার দ্বিতীয় যুগ আরম্ভ হয়। এ আমলে মসজিদ ছাড়াও মাদরাসার জন্য আলাদা ঘর নির্মান করা হয় এবং ইমাম ও শিক্ষকগণ কে সরকারী কোষাগার হতে বেতন দেয়া হত। পরবর্তীতে আব্বাসীয় শাসনকালে উচ্চ শিক্ষা কেন্দ্র ( জামিয়া) হিসেবে নিশাপুর, বাগদাদ, কর্ডোভা, আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠে। মুসলিম শাসনামলে উপ-মহাদেশে সর্বত্র মসজিদ, মক্তব, মাদরাসা, খানকাহ এর মাধ্যমে শিক্ষা দেয়া হত। এ সকল প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ভার উইল, ওয়াকফ ও হেবা সম্পত্তির দ্বারা মেটান হত। পরে ব্যাপকভাবে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের জন্য মসজিদে নববীর অনুকরণে সকল জায়গায় ইসলামী মসজিদ ভিত্তিক মাদরাসা স্থাপনের জোর প্রচেষ্টা অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। যার পরিপ্রেক্ষিতে সর্বত্র মসজিদ ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়ে যায়। অতপরঃ নিজামুল মূলকের দরসে নিজামী হয়ে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বাংলায় প্রতি চারশত অধিবাসীর জন্য গড়ে উঠে একটি করে মক্তব এ হিসাবে প্রায় আশি হাজার মক্তব ছিল।
পরে উপমহাদেশে ১৭৮০ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক বাংলার মুসলমানদের প্রতিষ্ঠিত হয় কলিকাতা মাদরাসা, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক সংস্কার কৃত হয়ে ০২রা মার্চ ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডে রূপনেয়। ১৯৮০ সালে সরকার মাদরাসা শিক্ষাকে ক্ষেত্র বিশেষ সাধারণ শিক্ষার সমমান হিসেবে স্বীকৃতী দেয় এবং মাদরাসা শিক্ষকদেরকে জাতীয় বেতন কাঠামোর আওতাভূক্ত করে। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে দাখিলকে এস এস সি,১৯৮৭ সালে আলিমকে এইচ এস সি,২০০৭ সাল থেকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়ার অধীনে ফাযিল ও কামিলকে যথাক্রমে ডিগ্রি ও মাষ্টার্স এর মান দেয় । বাংলাদেশ মাদরসা শিক্ষাবোর্ড, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া এবং ১লা সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে চলছে বাংলাদেশের আলিয়া মাদরাসার শিক্ষা ব্যবস্থা।